রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গেরিলা কমান্ডার, বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজনীতিবীদ মোস্তফা মহসীন মন্টুর ২য় জানাজা সম্পন্ন। 

36

কেরানীগঞ্জ প্রতিনিধি

স্বাধীনতা যুদ্ধের গেরিলা কমান্ডার,বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক এবং গণফোরাম সভাপতি মোস্তফা মহসীন মন্টু এর ২য় নামাজের জানাজায় জনতার ঢল নেমেছে। দলমত নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকের সমাগমের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্জদায় গার্ড অফ অনারের শেষে সমাপ্ত হলো মরহুমের ২য় জানাজা । গত কাল সোমবার সকলে তার গ্রামের বাড়ি কেরাণীগঞ্জের কালিন্দী ইউনিয়নের নেকরোজবাগ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে মাঠে জনতার উপস্থিতি। এসময় অনান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন গণফোরামের সাধারণ ড.মিজানুর রহমান,ঢাকা জেলার বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার এরফান ইবনে আমান অমি, কেরাণীগঞ্জ উপজেলার ডিপটি কমেন্ডার মো শাহবুদ্দিন, বিএনপির প্রবীন নেতা আলহাজ¦ নাজিম উদ্দিন, গণফোরামের নেতা রওশন ইয়াজদানী ও মো ফারুক। আরো উপস্থিত ছিলেন কেরাণীগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবীদ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ সুধী সমাজের লোকজন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকা অবস্থায় এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদ শনিবার বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।পারিবারিক সূত্র জানায়, বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভোগার পর সম্প্রতি তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, সন্তান, রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও অগণিত অনুসারী রেখে গেছেন।

মোস্তফা মহসীন মন্টুর এক সাহসী গেরিলা কমান্ডারের মুখচ্ছবি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন ঢাকা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। কেরানীগঞ্জ, ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকায় তিনি পরিচালনা করেন একের পর এক গেরিলা হামলা। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক নিঃশব্দ বজ্র। শহীদ, আহত ও নির্যাতিতদের স্মরণে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেন মন্টু। তার নেতৃত্বে ঢাকা শহরে পরিচালিত হয় গুরুত্বপূর্ণ বহু অপারেশন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও তাঁর অবস্থান ছিল চূড়ান্ত সাহস ও কৌশলের এক অনন্য উদাহরণ।
স্বাধীনতার পর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন মন্টু। তিনি ছাত্রজীবনে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। পরে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন।
১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯২ সালে দলীয় মতপার্থক্যের কারণে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে11 তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৭ থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ফন্টের মনোনীত প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন,পরে গণফোরামে, প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। দীর্ঘদিন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০২১ সালে দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালের সপ্তম কাউন্সিলেও পুনরায় সভাপতি হন। তিনি বরাবরই ছিলেন স্বচ্ছ, নীতিনিষ্ঠ এবং গণতন্ত্রমনা রাজনীতির একজন অগ্রসেনানায়ক।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মন্টুর ভূমিকা ছিল স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ। ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের প্রশ্নে কখনোই আপস করেননি। তিনি বলতেন,রাজনীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, এটি জাতির মন ও ভবিষ্যতের স্বার্থে হওয়া উচিত।
১৯৪৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ধানমন্ডিতে জন্মগ্রহণ করেন মোস্তফা মহসীন মন্টু। পিতার নাম মীর জাহান ও মাতার নাম রাহেলা খাতুন। রাজনৈতিক জীবনে তাঁর বিরুদ্ধে কখনো বড় কোনো বিতর্ক ওঠেনি। সততা, শুদ্ধতা ও আদর্শিক অবস্থান তাঁকে আলাদা উচ্চতায় স্থান দিয়েছিল। মোস্তফা মহসীন মন্টু ছিলেন এক হাতে বন্দুক, আরেক হাতে পতাকা ধরা রাজনৈতিক সংগ্রামী। তিনি রাজনীতিতে অগণিত মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন—সততার, সংগ্রামের, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার। তাঁর মতো মানুষের শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়। জাতি হারালো এক গেরিলা সৈনিক, একজন আদর্শ রাজনীতিক। কেরাণীগঞ্জ হারালো একজন সৎ অভিভাবক।